১৯৮৭ সালের ২৪ শে মার্চ মাগুরায় জন্ম। মাশরুর রেজার পরিবার কি সেদিন ভাবতে পেরেছিল তার পরিবারে জন্ম নেয়া সেই ছোট্ট সদস্যটিই একদিন বাংলাদেশের গর্ব হবেন? বাবার অবাধ্য হয়ে ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতেন ছোটবেলায়। অবাধ্য সেই ছোট্ট ফয়সালই আজ শুধুবাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের গর্ব। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব যাকে চিনে সাকিব আল হাসান নামে। ২০০৬ সালের আগস্ট মাসের ৬ তারিখ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে প্রথমবারেরমতো পা রাখেন। এরপর আর তাকাতে হয় নি পেছনের দিকে। সাকিব মানেই তো এগিয়ে যাওয়া,সাকিব মানেই তো অনুপ্রেরণা। সেখান থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর ২০১৯। মাঝের প্রায় ১৪ বছরে বাইশগজে সাকিব রাজত্ব করেছেন নিজস্ব স্টাইলে। বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলতেনেমেছেন প্রথমবার। বিশ্বকাপের অভিষেকের সেই ম্যাচে অর্ধশতক করে বাঘের মতো গর্জন করে জানান দিলেন,“তৈরি থাকো বিশ্ব, এই ক্রিকেট শাসন করতে নতুন এক নবাবের আভির্ভাব হয়েছে”।
সাবেক অধিনায়ক মাশরাফির সাথে সাকিবের ছিলো বেশ সখ্যতা। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগটাও পেয়েছিলেন মাশরাফির ইঞ্জুরিতে। বড় ভাইয়ের দেখিয়ে দেয়া, রেখে যাওয়া দায়িত্বটাও পালন করলেন বেশ নির্ভুলভাবে। ঘরের মাঠে ধবল ধোলাই হলো ক্যারিবিয়ানরা। কিউইদের ডেকে এনে ৪-০ তে করলেন বাংলাওয়াশ। সিরিজসেরা হলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান নিজেই। সাকিব আল হাসান কখনো কখনো ছিলেন আড়ালের নায়ক। ২০১২ এর এশিয়া কাপে তামিমের চার ফিফটি করে গুনে গুনে চার আঙ্গুলের সেলেব্রেশনের আড়ালে থেকে গেছে সাকিব আল হাসান নামকএকজনের তিন ফিফটির গল্প। প্রথমবারের মতো আইসিসির
কোন টুর্নামেন্টে হলেন ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট। এভাবে রঙিন শুরু যার তার শেষটা কিভাবে মলিন হয়? গেল বিশ্বকাপের
মহামঞ্চে একের পর এক অবিশ্বাস্য সব রেকর্ড, একমাত্র অলরাউন্ডার হিসেবে ক্রিকেটেরতিন ফরম্যাটেই নাম্বার ওয়ান। ক্রিকেটের রথী-মহারথীদের টপকে সাকিব হয়ে উঠেন একজন নবাব। সাকিব আল হাসান মানে বেন স্টোকসকে নবাবীয়ানা দেখানো, ওয়াহাব রিয়াজের দিকে আঙ্গুল তুলে শাসানো। শ্রীলংকার বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ দেখানো।
“অনেক বড় হতে হবে দাদুভাই, এতো বিখ্যাত হতে হবে যে দুনিয়ার সবাই জানবে তোমার নাম।যখন তুমি বাড়ি আসবে সবাই দল বেঁধে ভিড় জমাবে তোমায় দেখতে”
ছোট্ট ফয়সালের মনে তার দাদা যে স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন, সে স্বপ্ন আজ মিথ্যে নয়। সাকিবের জন্মদিনে, নিষেধাজ্ঞার দিনের প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন হাতে দাঁড়ানো সেই ভিড় তার
দাদার দেখানো স্বপ্নের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই যে এতো এতো রেকর্ড, ক্রিকেটীয় বিচার-বিশ্লেষণ এসব দিয়ে আপনি অন্যদের মাপতে পারলেও, পারবেন না একজন সাকিব আল হাসানকে মাপতে। এই সাকিবকে অনুধাবন করতে হয় হৃদয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। দিনের পর দিন আমাদের বাংলাদেশের ক্রিকেটটাকে উঁচুতে নিয়ে গেছেন যিনি। ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা হয়ে দেশ বিদেশের মঞ্চে উঁচু করে জানান দিয়েছেন আমাদের দেশের নাম।
প্রিয় সাকিব আল হাসান,
আপনি বলেছিলেন, আইপিএলের হয়ে শিরোপা জেতার চেয়ে বাংলাদেশের জার্সি তে একটা ম্যাচজেতা বেশী সম্মানের। আমরাও তাই বুঝি, তাই জেনেই আনন্দিত হই। কদিন পরেই আবার আসতে যাচ্ছে আরাধ্যের বিশ্বকাপ আসর। আমরা স্বপ্ন দেখতে জানতাম না, আপনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, স্বপ্ন ছোঁয়া দূরত্বেও নিয়ে গিয়েছিলেন। মানুষ তো প্রিয় মানুষের কাছেই আবদার করে। আপনি বাংলাদেশের প্রিয় মানুষ। একটা বিশ্বকাপ চাই আপনার কাছে। হয়তো পাবেন, হয়তো-বা পাবেন না। কিন্তু জেনে রাখুন বিশ্বকাপ যদি আপনার হাত ধরে না ও আসে তবুও আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।
করোনা মহামারীর ভয় আর আপনার সাফল্যের গল্প লিখতে লিখতে ভুলেই গিয়েছি আপনারনিষেধাজ্ঞার সময়ও শেষ হয়েছে, সবাই ভাবছে আপনি আবার আপনার স্বরূপে চেনা পরিচিত ময়দানের রাজত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারবেন তো? কিন্তু সবাই হয়তো ভুলে গিয়েছে জগতের চিরাচরিত নিয়মের কথা। ভরা পূর্নিমায় আলো দেয়া চাঁদটাও ঘোর অমাবস্যায় কালোর মাঝে হারিয়ে যায়। ঠিকই আবার অমাবস্যার ঘোর কালো থেকে বেরিয়ে এসে পূর্নিমায় আবার আলোকিত করে ভুবন।
চাঁদের নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের আলোতে আলোকিত। আপনি আমাদের কাছে সেই সূর্যের মতো। আপনার দীপ্তিময় ব্যাটিং-বোলিংয়ের ঝলকানিতে আলোকিত হয় আমাদের ক্রিকেট, আপনার হাসিতে হাসে বিশ্ব। আপনার জীবনে এমন অমাবস্যা নেমে আসা প্রথমবার নয়, এর আগেও আপনার জীবনে অমাবস্যার এমন কালো ছায়া নেমে এসেছিলো। আপনি সেখান থেকে ঠিকই ফিরে এসেছেন, আলোকিত করেছেন ক্রিকেট বিশ্ব। কখনো ১৬ বলে ৪৪ রানের মহাপ্রলয় তুলে, কখনো ইতিহাস গড়া সেঞ্চুরি এবং ১০উইকেট নিয়ে।
তাহলে এবার কেন আপনি পারবেন না? আপনি তো ক্লাসের সেই ছাত্র যে জানে তার নিজের শক্তি এবং যোগ্যতা সম্পর্কে। প্রতিবার যে ছাড়িয়ে যায় নিজেকে নিজে। শেষবার যখন আপনাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখি, আমি আপনার চোখে দেখতে পেয়েছি অন্যরকম এক আলোর দিশা। যেখানে চোখে মুখে খেলা করছে দ্বিগুণ তেজ, নিজেকে ফিরে পাবার এক অন্যরকম ক্ষুধা। আপনার এমন রুপ জানান দেয় আপনি আরও কঠিন হয়ে ফিরবেন আপনার স্ব-মহিমায়, নিজস্ব স্টাইলে। আমার বিশ্বাস বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে আপনি আপনার জয়ের বন্দরে ঠিকই নোঙর ফেলবেন, রেকর্ড বইয়ের পাতা উল্টে পাল্টে লিখবেন নতুন কোন ইতিহাস, শাসন করবেন ক্রিকেট বিশ্ব। বাংলাদেশ নামক ছোট্ট এই দেশের শেষ নবাব তো আপনিই! ক্রিকেট বিশ্বের এমন শাসন তো আপনাকেই মানায়, আর তাইতো রাজ্যের অলিগলিতে ছোট থেকে বড় সবাই নিজের অজান্তেই গুনগুন করেন—–“বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রান সাকিব আল হাসান, সাকিব আল হাসান”
আর আমরাও সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠি- “আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে”